বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠ নড়ে উঠে। কখনও কখনও এই নড়াচড়া তীব্রতা ধারণ করে, আবার কখনও কখনও এর নড়াচড়া এতোটাই নিতান্তই হয়ে থাকে যে, অনেকেরই তা অনুভূত হয় না।
ভূপৃষ্ঠের এমন নড়াচড়াকে ভূমিকম্প বলে। এছাড়া সমুদ্রেও ভূমিকম্প হয়ে থাকে। সমুদ্রের নিচের মাটির নড়াচড়াই সমুদ্রের ভূমিকম্প।
ভূ-তত্ত্ববিজ্ঞানীরা সাধারণত ভূমিকম্পের উৎপত্তির তিনটি কারণ উল্লেখ করে থাকেন—ভূপৃষ্ঠজনিত, আগ্নেয়গিরিজনিত ও শিলাচ্যুতিজনিত কারণে ভূমিকম্প হয় বলে ধারণা করেন।
এই বিষয়টিকে আরো একটু বুঝিয়ে বলছি:
সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে।
ভূমিকম্পের কারণ,
ভূপৃষ্ঠজনিত:
পৃথিবীর ভূ -পৃষ্ঠ অনেকগুলো প্লেট-এর সমন্বয়ে গঠিত। এই প্লেটগুলো একটি অপরটির থেকে আলাদা থাকার অংশকে ফল্ট বা ফাটল বলে। এই প্লেটগুলোর নিচেই ভূ-অভ্যন্তরের সকল গলিত পদার্থ থাকে। কোনো প্রাকৃতিক কারণে প্লেটগুলোর নিচের এই গলিত পদার্থগুলোর স্থানচ্যুতি ঘটলে প্লেটগুলোরও কিছুটা স্থানচ্যুতি ঘটে। এ কারণে একটি প্লেটের গলিত পদার্থগুলোর স্থানচ্যুতির কারণে ফাঁকা অংশের সৃষ্টি হয়ে অপর প্লেটের তলায় ঢুকে যায়, যার ফলে ভূমিতে কম্পন সৃষ্টি হয়। আর এই কম্পনই ভূমিকম্প রূপে আমাদের নিকট আবির্ভূত হয়।
ভূমিকম্প:
ভূমিকম্প হচ্ছে ভূমির কম্পন। ভূ অভ্যন্তরে একটি শিলা অন্য একটি শিলার উপরে উঠে আসার ফলে ভূকম্পনের সৃষ্টি হয়। পৃথিবীপৃষ্ঠের অংশ বিশেষের হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তনের আন্দোলিত কম্পনই ভূমিকম্পন।
গবেষকরা ধারণা করেন যে, বিশ্বে বছরে গড়ে প্রায় ছয় হাজার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এগুলোর অধিকাংশই মৃদু, যা সাধারণত আমাদের অনুভূত হয় না। ভূমিকম্পের মাত্রা বিবেচনায় সাধারণত তিন ধরনের ভূমিকম্প হয়- প্রচণ্ড, মাঝারি ও মৃদু।
আবার উৎসের গভীরতা অনুসারে ভূমিকম্পকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়- অগভীর, মধ্যবর্তী ও গভীর ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ভূ-পৃষ্ঠের ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে অগভীর, ৭০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে মধ্যবর্তী ও ৩০০ কিলোমিটারের নিচে হলে তাকে গভীর ভূমিকম্প হিসেবে অভিহিত করা হয়।
আগ্নেয়গিরিজনিত:
কখনো কখনো আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ও গলিত লাভা উৎক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে।
শিলাচ্যুতি বা শিলাতে ভাজের সৃষ্টি:
পৃথিবীর অভ্যন্তরে শিলাচ্যুতি বা শিলাতে ভাঁজের সৃষ্টি হলে ভূত্বকের কোনো অংশ উপরে উঠে যায় বা নিচে নেমে যায় এবং চ্যুতির সমতলে প্রবল ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়ে কেঁপে উঠে। এই কম্পনও ভূমিকম্প।
ভূপাত:
কোনো প্রাকৃতিক কারণে পাহাড়-পর্বত হতে বৃহৎ শিলাখণ্ড ভূত্বকের ওপর ধসে পড়ে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। সাধারণত ভাঁজ পর্বতের নিকট অধিক ভূমিকম্প হয়।
তাপ বিকিরণ:
ভূত্বক তাপ বিকিরণ করে সংকুচিত হয়ে পড়লে ফাটল ও ভাঁজের সৃষ্টি হয়ে ভূমিকম্প হয়।
ভূগর্ভস্থ বাষ্প:
নানা কারণে ভূগর্ভে বাষ্পের সৃষ্টি হয়। এই বাষ্প ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলে তা ভূত্বকের নিম্নভাগে ধাক্কা দেয়; ফলে প্রচণ্ড ভূকম্পন অনুভূত হয় এবং ভূমিকম্প হয়।
হিমবাহের প্রভাবে,
কখনো কখনো প্রকাণ্ড হিমবাহ পর্বতগাত্র হতে হঠাৎ নিচে পতিত হয়। এতে ভূত্বক কেঁপে ওঠে এবং ভূমিকম্পনের সৃষ্টি হয় ফলে ভূমিকম্প হয়।
ভূমিকম্পের কেন্দ্র:
পৃথিবীর অভ্যন্তরে যেখান থেকে ভূকম্প-তরঙ্গ উৎপন্ন হয়, তাকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্র থেকে কম্পন ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের মাধ্যমে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। শিলার পীড়ন-ক্ষমতা সহ্যসীমার বাহিরে চলে গেলে শিলায় ফাটল ধরে ও শক্তির মুক্তি ঘটে। তাই প্রায়শই ভূমিকম্পের কেন্দ্র চ্যুতিরেখা অংশে অবস্থান করে। সাধারণত ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৬ কিমি.-র মধ্যে এই কেন্দ্র অবস্থান করে। তবে ৭০০ কিমি. গভীরে গুরুমণ্ডল (Mantle) থেকেও ভূ-কম্পন উত্থিত হতে পারে।
ভূমিকম্পের ফলাফল:
ভূমিকম্পের ফলে পৃথিবীতে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। যেমন:
ভূমিকম্পের ফলে ভূ-ত্বকে অসংখ্য ফাটল এবং স্থানচ্যুতির সৃষ্টি হয়। কখনো এতে সমুদ্রতলের অনেক স্থান উপরে ভেসে ওঠে দ্বীপের সৃষ্টি হয়। কখনো স্থলভাগের অনেক স্থান সমুদ্রতলে ডুবে যায়। অনেক সময় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যায়। ভূমিকম্পের ঝাকুনিতে পর্বতের ধ্বস নেমে যায়। ভূমিকম্পের ফলে অনেক সময় জলোচ্ছ্বাস বা সুনামির সৃষ্টি হয়। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভূকম্পনের ফলে সৃষ্ট সুনামির আঘাতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, থাইল্যাণ্ড, ভারত প্রভৃতি দেশে ব্যাপক হারে ক্ষতি সাধিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দুর্ভিক্ষ-মহামারিতে বহু প্রাণহানি ঘটে। ভূমিকম্পে রেলপথ, সড়কপথ, পাইপ লাইন, বাড়িঘর প্রভৃতি ভেঙে যায় এবং যাতায়াত ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে।
এই তো এবছরের ঘটনা, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প গাজিয়ানতেপ শহর থেকে পশ্চিমে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে স্থানীয় সময় রাত ৪:১৭ মিনিটে (১:১৭ ইউটিসি) আঘাত হানে, যার ফলে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, পরবর্তীতে মৃতের সংখ্যা দীর্ঘ হতে থাকে। ৯ ফেব্রুয়ারি নাগাদ মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪,০০০ জনেরও বেশি।
0 Comments